শনিবার, ২৮ Jun ২০২৫, ০৭:৫৩ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

রোহিঙ্গাদের নতুন জীবন, ধ্বংসস্তুপে নতুন স্বপ্ন

উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ধ্বংস্তুপে রোহিঙ্গা পরিবার-ছবি: কক্সবাজার ভয়েস ডটকম।

আবদুল আজিজ:
মিয়ানমার সেনাদের গণহত্যা ও বর্বর নির্যাতনের দু:সহ স্মৃতি ভুলতে না ভুলতেই বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের কিছু অংশ আবারও মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। উখিয়ার বালুখালীতে অগ্নিকান্ডে সবকিছু হারিয়ে পথে ৪৫ হাজারের বেশী রোহিঙ্গা। রাক্ষুসী আগুন জীবন তছনছ করে দিয়েছে। রোহিঙ্গাদের জীবনযুদ্ধে দু:খ-দুর্দশা যেন পিছু ছাড়ছে না। তারপরও নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছেন তারা। ভয়াবহ আগুনে পুড়ে যাওয়া ধ্বংসস্তুপের মাঝে আবারো বসতি গড়ছে রোহিঙ্গারা। দেখছে নতুন স্বপ্ন।

উখিয়ার বালুখালী ৮নং ক্যাম্পে ধ্বংসস্তুপে খোলা আকাশের নিচে বসে থাকা রোহিঙ্গা নারী ফরিদা বেগম (৪৫) এর সাথে কথা হয়। তিনি কক্সবাজার ভয়েসকে জানান, ‘আমি এখন নি:স্ব। আগুন সবকিছু কেড়ে নিয়ে গেছে। আমার এক ছেলে শফি উল্লাহ আগুনে পুড়ে আহত। সে এখনা হাসপাতালে আছে। তাকে হাসপাতালে রেখে ক্যাম্পে এসেছি কিছু পাওয়ার আশায়। আমার ঘরের কিছু নেই। বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট। একবেলা রান্না করা খাবার পেয়েছি। কিন্তু, নেই থালা-বাসন, হাড়ি পাতিল। নেই খাওয়ার জন্য জগ-গ্লাসও।

একই ক্যাম্পের বাসিন্দা বৃদ্ধ আব্দু জব্বার জানান, মিয়ানমারের দু:সহ স্মৃতি ভুলতে না ভুলতে আবারও মানবিক বিপর্যয় ঘটলো জীবনে। হঠাৎ আগুন এসে সবকিছু ধুলোয় মিশে দিল। আগুন কোথাও থেকে এসেছে টের পায়নি।’

উখিয়া বালুখালী ৯নং রোহিঙ্গা শিবিরের বাসিন্দা ক্ষতিগ্রস্ত আবুল কালাম কক্সবাজার ভয়েসকে জানান, ‘সবকিছু আগুনে পুড়ে একাকার। কোনো জিনিসপত্র, টাকাপয়সা নেই। আসবাব পুড়ে মাটিতে মিশে গেছে। সেসবের ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করে এনজিওদের কাছ থেকে পাওয়া বাঁশ-ত্রিপল দিয়ে ঘর তৈরীর চেষ্টা করছি।’

গত সোমবার কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী ৮ ও ৯ নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ভয়াবহ আগুন লেগে নি:স্ব হয়ে যায় ৯ হাজার ৩ শত পরিবারের ৪৫ হাজার রোহিঙ্গা। এসব রোহিঙ্গা প্রাণে বেচে গেলেও বাঁচতে পারেনি ১১জন রোহিঙ্গা নারী পুরুষ। আগুনের লেলিহান শিখায় প্রাণ যায় তাদের। এসময় আহত হয় অনেকেই। কিন্তু, ভয়াবহ আগুনের দু:সহ স্মৃতি বুকে নিয়ে পুড়া মাটিতে ফিরছে তারা। ইতিমধ্যে সরকারের পাশাপাশি ‘ইউএনএইচসিআর’, ‘আইওএম’, ‘রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি’, ‘ডব্লিউএফপি সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও দেশী এনজিও সংস্থা নি:স্ব এসব রোহিঙ্গাদের তাবু সহ জরুরী সহায়তা দিচ্ছে। আশ্রয় সরঞ্জামাদি, খাবার পানি, রান্না করা খাবার, মাস্ক, সাবান, কম্বল, সোলার লাইট, মশারি এবং জেরিক্যান পৌছে গেছে প্রতিটি রোহিঙ্গা পরিবারের কাছে। পাশাপাশি ত্রিপল ও বাঁশ টানিয়ে কিছু শেটও নির্মান করে দেওয়া হচ্ছে। অগ্নিকান্ডে মাথা গোঁজার ঠাঁই হারিয়ে নিঃস্ব অসহায় অবস্থায় দিনানিপাত করা রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প নতুন করে স্বাভাবিক হয়ে আসছে। তবে খাবার পানি ও সরঞ্জাম তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।

এদিকে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অগ্নিকান্ডের ঘটনা নিয়ে সাধারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। স্থানীয় গ্রামবাসী ও সাধারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যে ধারণার সৃষ্টি হয়েছে যে, অগ্নিকান্ডের ঘটনাটি ‘পরিকল্পিত।’ সাধারণ রোহিঙ্গাদের অনেকেই বলছেন, অগ্নিকান্ডের ঘটনাটি ‘আতœঘাতি।’ তবে এসব রোহিঙ্গারা এ বিষয়ে তেমন বেশী মুখ খুলতে রাজি নয়। যারা এ ঘটনার নেপথ্যে কাজ করেছে বলে সন্দেহ করছে তারা ক্যাম্পটিতে সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ হিসাবে সবার কাছে পরিচিত। তাদের ভয়ে সাধারণ রোহিঙ্গারা মুখ খুলতে পারছে না। সাধারণ রোহিঙ্গাদের এসব সন্ত্রাসী রোহিঙ্গারা জিন্মী করে রেখেছে। গত তিন বছরে ক্যাম্প গুলোতে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী কার্যক্রমে এ পর্যন্ত ৬০ জনেরও অধিক রোহিঙ্গা প্রাণ হারিয়েছে।

উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অভ্যান্তরে বসবাসরত স্থানীয় বাংলাদেশী যুবক মুবিনুল হক (২৫) কক্সবাজার ভয়েসকে জানিয়েছেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আগুন দুর্ঘটনা নয়, এটি একটি পরিকল্পিত ও আত্মঘাতি আগুন। ক্যাম্পের আধিপত্য নিয়ে একটি উগ্রবাদি রোহিঙ্গা গ্রুপ কেরোসিন ও পেট্রোল দিয়ে পুরো রোহিঙ্গা ক্যাম্প জালিয়ে দিয়েছে। নিজেদের ক্যাম্পে নিজেরা আগুন ধরিয়ে দেয়ার ঘটনার আমি প্রত্যক্ষদর্শী এবং আমার চোখে দেখা একটি আত্মঘাতি ঘটনা।’

কারণ জানতে চাইলে মুবিনুল আরও জানান, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পের চারপাশে কাটাতাঁরের বেড়া নির্মাণ করায় কিছু রোহিঙ্গা অসুন্তুষ্ট। এছাড়া ক্যাম্পের আধিপত্য নিয়ে গ্রুপিং রয়েছে। এসব রোহিঙ্গারা চায় ক্যাম্পের ভেতরে আইনশৃংখলা বাহিনীর কর্তৃত্ব না থাকুক। শুধু রোহিঙ্গা ক্যাম্প ওই গ্রুপ গুলো নিয়ন্ত্রণ করুক’।

উখিয়া উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তা নিজাম উদ্দিন আহমেদ কক্সবাজার ভয়েসকে জানান,‘ক্ষতিগ্রস্থ রোহিঙ্গাদের যাতে অন্ন ও বাসস্থান নিয়ে কোন প্রকার সমস্যার সৃষ্টি না হয় সে লক্ষে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থ রোহিঙ্গাদের আশ্রয়ের জন্য জরুরি ভিত্তিতে তাবু সহ প্রয়োজনিয় আশ্রয় সরঞ্জামাদি প্রদান করা হয়েছে।’

কক্সবাজার শরনার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শাহ্ রেজওয়ান হায়াত কক্সবাজার ভয়েসকে জানান, ‘অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রাথমিকভাবে রান্না করা ও শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। রোহিঙ্গারা যাতে খোলা আকাশের নিচে না থাকে সেজন্য বাঁশ ও ত্রিপলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে নগদ টাকাসহ যাবতীয় সবধরণের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। একারণে রোহিঙ্গারা ক্যাম্পে ফিরছে এবং নতুন করে ঘর তৈরী হচ্ছে। আমাদের আইনশৃংখলা বাহিনী রোহিঙ্গাদের বরাবরের মতো সহযোগিতা দিয়ে আসছে’।

অপরদিকে ক্যাম্পে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনায় প্রাণহানি ও ধ্বংস লীলায় থানায় নিয়মিত মামলা হওয়ার কথা থাকলেও কোন ধরণের মামলা হয়নি বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির জ্যেষ্ট আইনজীবী এবং সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন-‘ এত বড় একটি ম্যাচাকার ঘটনার পরেও এখনো মামলা না করা বা বিলম্বে মামলা করা হলে সঙ্গত কারণেই ক্ষতিগ্রস্থ পক্ষ আইনের চোখে সন্দেহের মুখে পড়ে থাকে। তাই দ্রুত মামলা রুজু করা উচিত।’

উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি/তদন্ত) গাজী সালাহ উদ্দিন কক্সবাজার ভয়েসকে জানিয়েছেন-‘সোমবারের অগ্নিকান্ড নিয়ে হতাহত এবং সম্পদহানি বিষয়ে আজ (বৃহষ্পতিবার) পর্যন্ত কেউ মামলা নিয়ে থানায় আসেনি। তাই এ ব্যাপারে কোন নিয়মিত মামলাও রুজু করা হয়নি।’

গত ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমারের রাখাইনে সে দেশের সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা কক্সবাজারে উখিয়া-টেকনাফে আশ্রয় নেয়ার পর থেকে ছয়টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। তবে এবারই আগুন ভয়াবহ রূপ পায় এবং প্রাণহানির সংখ্যাও বেশী। আগের সব ঘটনায় গ্যাস সিলিন্ডার বা রান্নাঘর থেকে আগুনের সূত্রপাত হলেও সোমবারের ঘটনা পরিকল্পিত বলে দাবি করছে রোহিঙ্গারা। তবে কোন অগ্নিকান্ডের ঘটনা তদন্ত হয়নি।’

ভয়েস/আআ

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION